মঙ্গলবার ২৯ এপ্রিল ২০২৫ - ১২:২১
ফাতিমা মাসুমা (আঃসা): জীবনের অনন্ত শিক্ষা

শিয়া সমাজে ইমামের বংশধর সর্বাধিক পবিত্র এবং মূল্যবান দীনদারী ও তাওহিদী জীবনের আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হন। তাঁদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন,সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনে,ইবাদত বন্দেগী এবং আধ্যাত্মিক জীবন সমগ্র ইসলামী সমাজের জন্য শিক্ষণীয় এবং অনুকরণীয় ছিল।

হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী,

ভূমিকা:
শিয়া সমাজে ইমামের বংশধর সর্বাধিক পবিত্র এবং মূল্যবান দীনদারী ও তাওহিদী জীবনের আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হন। তাঁদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন,সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনে,ইবাদত বন্দেগী এবং আধ্যাত্মিক জীবন সমগ্র ইসলামী সমাজের জন্য শিক্ষণীয় এবং অনুকরণীয় ছিল।

কারণ, ইমামের বংশধর সবসময় চেষ্টা করেছেন নিজেদের জীবনকে ইমামত ও বেলায়াতের সঠিক পথের সাথে মিলিয়ে চলতে এবং নিজেদের সঠিক আচরণের মাধ্যমে মানুষের জন্য সৌভাগ্যের এবং আধ্যাত্মিকতার পথ প্রশস্ত করতে।

সমস্ত ইমামের বংশধরের মধ্যে এমন কিছু মহান ব্যক্তিত্ব আছেন, যাদের ব্যাপারে ইমামদের বিশেষ সুপারিশ ও বর্ণনা রয়েছে, যা তাঁদের মর্যাদা ও মহত্বের প্রমাণ বহন করে।

এইসব ইমামের বংশধরের মধ্যে একজন হলেন হযরত মূসা ইবনে জাফর (আঃ)-এর কন্যা, হযরত ফাতিমা মাসুমা (আঃ সা)। তাঁর সম্পর্কে  ইমাম জওয়াদ (আ:) বলেছেন:
"من زار عمتي بقم فله الجنة"
"যে ব্যক্তি কুম-এ আমার ফুফুকে (ফাতিমা মাসুমা)-কে জিয়ারত করবে, তার জন্য জান্নাত রয়েছে।"

 বংশ পরিচয়:
হযরত মাসুমা (সা.) ছিলেন ইমাম মূসা কাযিম (আ.) এর কন্যা এবং ইমাম আলী রেযা (আ.)-এর বোন। তাঁর মা ছিলেন নাজমা খাতুন ,যিনি ছিলেন পবিত্র ও ধর্মপরায়ণা এক মহিলা। তিনি ১লা জিলক্বদ,১৭৩ হিজরী মদিনায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং বর্তমানে ইরানের পবিত্র শহর কুম-এ সমাধিস্থ।

ইতিহাসের অবহেলা:
হযরত ফাতিমা মাসুমা (আ:সা)-এর জীবনদর্শনে নিহিত মূল্যবান সাংস্কৃতিক, নৈতিক, শিক্ষামূলক এবং কুরআনী রত্নসমূহ, মানুষের জন্য সৌভাগ্য ও পূর্ণতার মানচিত্র ও পথনির্দেশনা হিসেবে বিদ্যমান ছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, ইতিহাস লেখকরা এই মহান ব্যক্তিত্বের জীবনকে যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

তাদের অবহেলার কারণে, ইতিহাস আজ লজ্জিত হওয়া উচিত, কেননা তারা এই মহান জীবনচিত্র ও কুরআনী নৈতিকতা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করেনি। গবেষকদের বক্তব্য মতে:
"হযরত ফাতিমা মাসুমা (আঃসা)-এর জীবন সম্পর্কে আমরা তেমন তথ্য পাই না; যেমন তাঁর জন্ম ও ওফাতের তারিখ, জীবনকাল, কখন তিনি মদিনা থেকে রওনা হয়েছিলেন, এবং তিনি ইমাম রেজা (আ:)-এর শাহাদতের আগে না পরে ইন্তেকাল করেছেন - এসব বিষয়ে স্পষ্ট তথ্য ইতিহাসে সংরক্ষিত নেই।" 

তবুও, তাঁর সামান্য পরিচিত গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যসমূহ, ইসলামী উৎসসমূহে এমনভাবে বিদ্যমান, যা পথপ্রদর্শক বাতির মতো হিদায়াত ও মুক্তির পথকে আলোকিত করে।

হযরত ফাতিমা মাসুমা (আঃসা)-এর জীবনধারা থেকে চিরস্থায়ী শিক্ষা:

১. জিয়ারতের সংস্কৃতি পুনরুজ্জীবন:
হযরত ফাতিমা মাসুমা (আ:সা)-এর জীবনধারার অন্যতম মূল্যবান দিক ছিল, ইমাম রেজা (আ:)-এর জিয়ারতের জন্য তাঁর হিজরত। এটি ছিল এক রাজনৈতিক, সামাজিক ও ইবাদতী আন্দোলন, যার মাধ্যমে তিনি শিয়া সমাজকে ইমাম অষ্টমের (আ:) পবিত্র দরবারের দিকে মনোনিবেশ করান এবং এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করেন।

'তারিখে কুম' গ্রন্থে উল্লেখ আছে, ২০১ হিজরীতে হযরত মাসুমা (আ:সা) তাঁর ভাই ইমাম রেজা (আ:)-এর সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে মদিনা থেকে ইরানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সে সময় আব্বাসীয় খলীফা মামুন ছিলেন এবং তিনি খোরাসানে অবস্থান করছিলেন। পথে তিনি অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। 

২. ইমাম পরিচিতি ও ওলায়ত অনুসরণে জীবন্ত আদর্শ:
হযরত ফাতিমা মাসুমা (আ:সা)-এর জীবনধারা ইমাম পরিচিতি এবং শিয়া ধর্মের দায়িত্ব সম্পর্কে চমৎকার শিক্ষা বহন করে। তাঁর জীবন ও বর্ণিত হাদীসসমূহ ইমামত ও ওলায়তের মূল ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল।

তিনি বর্ণনা করেন:
"ألا من مات على حب آل محمد مات شهيدا" 
অর্থাৎ, হযরত রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়ালিহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:
"শুনে রাখো! যে ব্যক্তি মুহাম্মদের আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে মৃত্যুবরণ করবে, সে শহীদ অবস্থায় মারা যাবে।"

তিনি নিজের প্রেম ও আনুগত্যের প্রমাণ স্বরূপ মদিনা থেকে তুস পর্যন্ত দীর্ঘ ও কষ্টকর পথ পাড়ি দেন, যা শুধুমাত্র ঈমান, ভালবাসা এবং ওলায়তের প্রতি গভীর বিশ্বাস থেকেই সম্ভব।

৩. সাহস ও ঝুঁকি গ্রহণ:
হযরত ফাতিমা মাসুমা (আ:সা)-এর জীবনধারায় সাহস, নির্ভীকতা এবং ঝুঁকি নেওয়ার অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল। বিশেষ করে, কঠিন সময়ে ইমাম রেজা (আ:)-এর উদ্দেশ্যে হিজরত, তার অনন্য দৃষ্টান্ত।

এছাড়া, কঠোর রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তিনি সাহসের সাথে গাদীর খুমের হাদীস সংরক্ষণ করেন এবং জনগণকে ওলায়তের গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দেন।

তিনি বর্ণনা করেন:
"أنسيتم قول رسول الله (ص) يوم غدير خم، من كنت مولاه فعلي مولاه..." 
অর্থাৎ,
"তোমরা কি ভুলে গেছো রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়ালিহি ওয়া সাল্লাম) গাদীর খুমের সেই উক্তি: 'আমি যার মাওলা, আলীও তার মাওলা'? এবং তাঁর আরেকটি উক্তি: 'তুমি (আলী) আমার কাছে হারুনের মতো আছো মূসার কাছে যেমন ছিল'?"

৪. ধৈর্য ও প্রতিরোধের মূর্ত প্রতীক:
হযরত ফাতিমা মাসুমা (আ:সা)-এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গুণ ছিল তাঁর অসীম ধৈর্য এবং প্রতিরোধ। মদিনা থেকে তুস পর্যন্ত বিপদসংকুল দীর্ঘ যাত্রা, পথের কষ্ট সহ্য করা এবং শত্রুদের মুখোমুখি হওয়া, তাঁর ধৈর্য, সাহস ও ওলায়তের প্রতি গভীর আনুগত্যের জ্বলন্ত প্রমাণ।

৫. দূরদর্শিতা ও বুদ্ধিমত্তা:
হযরত ফাতিমা মাসুমা (আ:সা)-এর জীবনধারার আরেকটি গৌরবময় বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর দূরদর্শিতা এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা। কঠিন রাজনৈতিক অবস্থার মাঝেও তিনি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং ইমামত ও ওলায়তের সপক্ষে সাহসী ভূমিকা রেখেছেন।

আল্লাহ তাআলার বাণীর সার্থক প্রতিচ্ছবি তিনি:
"قُلْ هَٰذِهِ سَبِيلِی أَدْعُو إِلَى اللَّهِ عَلَىٰ بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِی..." 
"বলুন: এই হল আমার পথ — আমি এবং যারা আমার অনুসরণ করে আমরা জ্ঞানের ভিত্তিতে আল্লাহর দিকে আহ্বান করি। আল্লাহ পবিত্র, আর আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।"

ওনার মর্যাদা ও গুণাবলী:
ইমাম আলী রেযা (আ.) বলেছেন:
"جعل الله كريمة أهل البيت فاطمة المعصومة شفيعةً لشيعتها"
— "আল্লাহ মাসুমা (সা.)-কে আহলে বাইতের রত্ন বানিয়েছেন এবং তিনি তাঁর শীয়াদের জন্য সুপারিশকারী হবেন।"
উপরের হাদিসটি থেকে আমরা বুঝতে পারি যে ,হজরত ফাতেমা মাসুমা (আ:সা) গুণাবলী ও মর্যাদা কতটা। শুধু তাই নয়, উনি এমন একজন ব্যক্তিত্বের নাম যিনি আমাদের সমাজের জন্য এক উত্তম আদর্শ।

উপসংহার:
হযরত ফাতিমা মাসুমা (আঃসা)-এর পবিত্র জীবন আমাদের সামনে দ্বীনি দায়িত্ব, ওলায়তের প্রতি আনুগত্য, ঈমানী দৃঢ়তা এবং আত্মিক পরিশুদ্ধতার এক উজ্জ্বল আদর্শ উপস্থাপন করে।
যদিও ইতিহাস তাঁর জীবনের সকল দিক যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়নি, তবুও তাঁর বিশুদ্ধ চরিত্র, সাহসিকতা, ধৈর্য, প্রেম এবং তাওহিদী আন্দোলন আমাদের জন্য চিরকালীন শিক্ষার উৎস।

তিনি প্রমাণ করে গেছেন যে, সত্যিকারভাবে আহলে বাইতের পথের অনুসারী হতে হলে কেবলমাত্র ইলম বা অনুভূতি নয়, বরং ইমানের দৃঢ়তা, আত্মত্যাগ, এবং কঠিন পরিস্থিতিতে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সাহস প্রয়োজন।
আজও, তাঁর কবরস্থান তথা কুম শহর জ্ঞানের দীপ্তিময় কেন্দ্র এবং ঈমানদারদের হৃদয়ে স্নেহ ও আনুগত্যের প্রতীক হিসেবে সমাদৃত।

হযরত মাসুমা (আঃসা)-এর জীবনদর্শন আমাদের শেখায় কিভাবে আধ্যাত্মিক এবং উঁচু মানের জীবন যাপন করতে হয়, এবং কিভাবে সত্য ও ন্যায়ের পতাকা উঁচিয়ে রাখতে হয়, চাই তা যতই কষ্টসাধ্য হোক।
তাঁর মহান আত্মা যেন আমাদেরকে সত্যপথে অবিচল রাখে এবং তাঁর সুপারিশ আমাদের জন্য জান্নাতের পথ সুগম করে—এই প্রার্থনা নিয়েই আমরা তাঁর পবিত্র জীবনচরিত থেকে শিক্ষা গ্রহণের অঙ্গীকার করি।

লেখক: কবির আলী তরফদার কুম্মী।
তারিখ: ২৯/০৪/২০২৫

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha